ফ্রান্স কি উগ্রপন্থী সেক্যুলার রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে?

ফ্রান্সের পার্লামেন্টে নতুন একটি আইন পাস করা নিয়ে আলোচনার সূচনা হয়। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে ৩৪৭ ভোট বনাম ১৫১ ভোটে ‘প্রজাতন্ত্রের ভিত্তিগুলোর ওপর সম্মানের সমর্থনে’ এই নতুন বিল পাস হয়। ৬৫ জন পার্লামেন্ট সদস্য ভোটদানে বিরত থাকেন। 

এই আইনের মাধ্যমে ফ্রান্সের মসজিদ, স্কুল ও স্পোর্টস ক্লাবগুলোর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো হবে। এটি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁর গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্পের অংশ, যার উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে- উগ্রবাদী ইসলাম থেকে ফ্রান্সকে ও ফ্রান্সের সেক্যুলার আদর্শকে রক্ষা করা। 

বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) জানায়, নিম্নকক্ষের পর এই বিল উচ্চকক্ষে যাবে ৩০ মার্চ; যেখানে এটি প্রায় নিশ্চিতভাবেই পাস হবে। ফ্রান্সের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর এই আইন ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে বলে মনে করছেন অনেকেই। একইসাথে ইসলামের প্রতি ফরাসিদের উগ্রপন্থী দৃষ্টিভঙ্গিরও বহিঃপ্রকাশ ঘটে এতে। 

এই আইনের বিপক্ষে থাকা রাজনীতিবিদরা বলছেন যে, আইনে যা প্রস্তাব করা হয়েছে, তা মূলত অন্যান্য আইনে ইতিমধ্যেই রয়েছে। এখানে অন্য কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা থাকতে পারে। বিল উত্থাপন করা ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমানিন পার্লামেন্টে ভোটাভুটির কিছুদিন আগেই বিরোধীদলীয় উগ্র ডানপন্থী নেতা মেরিন লে পেনের দিকে আঙুল তাক করে বলেন, লে পেন উগ্রবাদী ইসলামের প্রতি বেশ ‘নরম’ অবস্থান নিয়েছেন। তার ‘ভিটামিন দরকার’। এই মন্তব্যের উদ্দেশ্য এটি প্রমাণ করা যে, ম্যাখোঁর সরকার উগ্রবাদী ইসলামের ব্যাপারে উগ্র ডানপন্থীদের চেয়ে বেশি শক্ত অবস্থান নিয়েছে। ২০২২ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে ডানপন্থী ভোটারদের ম্যাখোঁর দিকে টেনে আনা এর লক্ষ্য হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। 

অপরদিকে, মেরিন লে পেন নতুন আইনকে দুর্বল বলছেন। বিএফএম টেলিভিশনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে লে পেনের উগ্র ডানপন্থী ন্যাশনাল র‌্যালি পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট জরডান বারডেলা বলেন, নতুন আইন ‘টার্গেট মিস করেছে’; কারণ এটি উগ্রবাদী ইসলামী আদর্শকে সরাসরি আক্রমণ করেনি। 

এপি জানায়, নতুন বিলে মুসলিম বা ইসলামের নাম উচ্চারিত হয়নি। সমর্থকরা বলছে, এই বিলে ফ্রান্সের সেক্যুলার আদর্শ ও লিঙ্গ সমতাকেই রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়েছে। ম্যাখোঁ এই বিলকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আইন বলছেন; কারণ উগ্রবাদীদের তিনি ফরাসি সমাজের বিরোধিতাকারী হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন।

নতুন আইনে তিন বছর বয়স থেকে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠিয়ে সেক্যুলার আদর্শ শেখানো বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে, যাতে করে শিশুর পরিবার নিজ বাড়িতে আলাদা করে কোনো আদর্শিক শিক্ষা দিতে না পারে। বাড়িতে শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। এতে বাড়িতে শিক্ষা নেয়া ৬২ হাজার শিশুর শিক্ষা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসবে। সরকারি অর্থে চলা মসজিদ ও মসজিদের ব্যবস্থাপনায় থাকা বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশনকে সেক্যুলারিজম মেনে চলার জন্য ফরাসি সরকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে হবে। নিয়মের বাইরে গেলে সরকারি অর্থ ফেরত দিতে হবে। আর দেশের বাইরে থেকে অর্থায়ন হলেও ১২ হাজার ডলারের বেশি অর্থ পেলে সরকারকে জানাতে হবে এবং বছরওয়ারি খরচের হিসাব দিতে হবে সরকারকে। 

পুলিশ অফিসার ও কারাগারের কর্মচারীদের ফ্রান্সের সেক্যুলার সংবিধান ও আদর্শের প্রতি নতুন করে আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ নিতে হবে। সরকারি অফিসে কাজ করা বা সরকারের জন্যে কাজ করা কোনো ব্যক্তি তার বিশ্বাস বোঝা যায়, এমন কোনো কাপড় পরতে পারবে না। এর মাধ্যমে মূলত মুসলিম নারীদের হিজাব পরাকেই বারন করা হয়েছে। একইসাথে সব সরকারি কর্মচারীকেও সেক্যুলারিজমের প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। 

যেসব খেলাধুলার অ্যাসোসিয়েশনকে উগ্রপন্থী বলে মনে হবে, সেগুলোকেও রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে আনা হবে। কোনো ডাক্তার যদি নারীর কুমারিত্বের সার্টিফিকেট দেন, তবে তাকে ১৮ হাজার ডলার জরিমানা ও এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া হবে। কোনো ব্যক্তির একসাথে দুই স্ত্রী থাকবে পারবে না; যদি কোনো অভিবাসী এটি করেন, তবে তাকে থাকার অনুমতি দেয়া হবে না। কোনো বিবাহকে যদি জোরপূর্বক বলে মনে হয়, তাহলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করা যাবে। নতুন এই আইনকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে ১৯০৫ সালের সেক্যুলারিজম আইনেও পরিবর্তন আনা হয়েছে; যার মাধ্যমে চার্চ ও রাষ্ট্রকে আলাদা করা হয়েছিল।

এদিকে বিল পাস হবার আগেই শ’দেড়েক মানুষ প্যারিসের রাস্তায় বিলের বিপক্ষে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করে। গত অক্টোবরে নিহত হওয়া ফরাসি শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটির এলাকার বাসিন্দা জেইনেব বুয়াবিবি সংবাদমাধ্যম ফ্রান্স টুয়েন্টিফোরকে বলেন, এক ব্যক্তির কর্মকাণ্ডের জন্য পুরো মুসলিম সমাজকে আক্রমণ করাটা একেবারেই অনুচিত। 

তিনি আরো বলেন, মুসলিম নাম হওয়ার কারণে ইউনিভার্সিটি ও কর্মক্ষেত্রে তাকে বিদ্বেষের শিকার হতে হয়েছে। অনেকেই তাকে বলেছেন, ‘তুমি তোমার দেশে ফেরত যাও!’ যদিও বুয়াবিবির জন্ম ফ্রান্সে। আর এ রকম আইন পাস হলে মুসলিমবিদ্বেষ আরো বেড়ে যেতে পারে। 

গত ১০ ফেব্রুয়ারি এই বিলের বিপক্ষে এক খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেন ১০০ জন ইমাম, ৫০ জন মুসলিম শিক্ষক ও ৫০ জন অ্যাসোসিয়েশন প্রেসিডেন্ট। 

ফ্রান্সে মুসলিমদের সংখ্যা ৩০ থেকে ৬৫ লাখের মাঝে হতে পারে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, ফ্রান্সের সেক্যুলার আইনে জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাসের কথা জিজ্ঞেস করা যায় না। ফরাসি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটুট মনটাইনের করা এক জনমত জরিপে বলা হয়, ফ্রান্সের মুসলিমদের ২৯ শতাংশ ইসলামের শরিয়া আইনকে রাষ্ট্রীয় আইনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। ৬৫ শতাংশ মুসলিম হিজাব পরার পক্ষে। 

আবার লে মন্ড পত্রিকার এক জরিপে বলা হয়, ৬০ শতাংশ ফরাসি মনে করে যে, ফ্রান্সের সেক্যুলার আদর্শের সাথে ইসলাম সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এমতাবস্থায় ফ্রান্সের নতুন আইন নিশ্চিতভাবেই মুসলিমদের বিশ্বাসগত বাধ্যবাধকতার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে যাচ্ছে, যা পশ্চিমা সেক্যুলার আদর্শের স্তম্ভ ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী। 

অপরদিকে, ম্যাখোঁর সরকার যখন নির্বাচনে জিততে উগ্র ডানপন্থীদের দলে টানার চেষ্টা করছেন, তখন গণতান্ত্রিকভাবেই এক উগ্রপন্থী সেক্যুলার রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে ফ্রান্স।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //